কুরবানী আদায়ে যেসব ভুলত্রুটি হতে দেখা যায়
কুরবানী আদায়ে যেসব ভুলত্রুটি হতে দেখা যায়
.
ණ মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া
ইবাদত সহীহ ও কবুল হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত রয়েছে। একটি হল, সহীহশুদ্ধভাবে ইখলাসের সাথে নিয়ত করা এবং দ্বিতীয়টি হল, শরীয়তে নির্ধারিত নিয়মনীতি অনুযায়ী করা। কুরবানীর ক্ষেত্রেও দু'টি শর্ত সমানভাবে প্রযােজ্য। সুতরাং কেউ যদি নিয়ত সহীহ ভাবে করল কিন্তু শরয়ী তরীকা ও বিধান অনুযায়ী কাজটি সম্পাদন করল না তাহলে সেটি ইবাদত বলে গণ্য হবে না। যেমনি ভাবে নিয়ত উল্টো হলেও তা ইবাদত গণ্য হয় না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ কএরেন, “এগুলাের গােস্ত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌছে না। তাঁর কাছে পৌঁছায় তােমাদের মনের তাকওয়া" -সূরা হজ্ব ৩৭
এখানে প্রথম শর্তের বর্ণনা এসেছে। আর দ্বিতীয় শর্তটির বর্ণনা রয়েছে হাদীস গ্রন্থহের কুরবানী অধ্যায়ে এবং কুরআন সুন্নাহর আলােকে আলােকে রচিত ফিকহের গ্রন্থাদিতে।
শর্তদু'টির প্রথমটি যেহেতু অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই সেটির ভুলত্রুটি আমাদের দৃষ্টিগােচর হয় না। দ্বিতীয় শর্তটি কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় প্রয়ােগের ক্ষেত্রে এর অনিয়ম ও ভুলত্রুটিগুলাে সহজেই ধরা পড়ে।
আমাদের সমাজে সাধারণত কুরবানী আদায়ে যেসকল ভুলত্রুটি বেশি বেশি ঘটে থাকে নিম্নে সেগুলাের উপর কিছু আলােকপাত করতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। যেন আসন্ন কুরবানীসহ পরবর্তীতে ওইসকল ভুলের শিকার আমরা না হই। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশনা অনুযায়ী এই ইবাদতটি পালন করে আমরা সকলেই যেন এর ফযীলত ও উত্তম প্রতিদান পেয়ে ধন্য হই। আমীন।
.
কুরবানী ওয়াজিব হওয়া না - হওয়া বিষয়ক ভ্রান্তি
==================================
.
কুরবানীর নেসাব
------------------------
.
অনেকে মনে করেন, যাকাত ফরয হওয়ার জন্য যে ধরনের সম্পদ জরুরি যেমন, টাকা-পয়সা , সােনা-রুপা, ব্যবসায়িক সম্পদ, তেমনি কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্যও একই শর্ত। ফলে কোন কোন স্বচ্ছল পরিবারের লােকজনকেও কুরবানী দিতে দেখা যায় না। এটি ভুল ধারণা। সঠিক মাসআলা হল, যে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নিকট কুরবানীর দিনগুলােতে সাড়ে ৫২ তােলা রূপার মূল্য পরিমাণ প্রয়ােজনের অতিরিক্ত যেকোন ধরনের সম্পদ থাকবে তার উপরই কুরবানী ওয়াজিব। প্রয়ােজনের অতিরিক্ত জমি, সৌখিন বা অপ্রয়ােজনীয় আসবাবপত্র, তা ব্যবহৃত হােক বা না হােক, এসব কিছুও কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। কিন্তু যাকাতের বেলায় এগুলাে ধর্তব্য হয় না। তাই টাকা-পয়সা, সােনা-চাঁদি ও ব্যবসায়িক সম্পদ না থাকলেও প্রয়ােজনের অতিরিক্ত ধনসম্পদ, আসবাবপত্রের মূল্য নেসাব পরিমাণ হলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২; আলমগীরী ৫/২৯২
.
কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার সময়
.-------------------------------------------
শুধু যিলহজ্বের ১০ তারিখে কুরবানীর নেসাব পরিমাণ সম্পদ না থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হবে না বলে ধারণা করা হয়। ফলে যিলহজ্বের ১১ বা ১২ তারিখে কারাে কারাে কাছে হঠাৎ কোনভাবে নেসাব পরিমাণ সম্পদ আসলে সে আর কুরবানী করে না। যেমন, যে অবিবাহিত মেয়ের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় কুরবানীর পরদিন তথা যিলহজ্বের ১১ তারিখে তার বিয়ে হল, সেদিন স্বামী তাকে স্বর্ণ, টাক-পয়সা ইত্যাদি দিল যা সাড়ে ৫২ তােলা রুযার পরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি। তখন সে এই ভেবে কুরবানী করে না যে, কুরবানীর দিন তাে অতিবাহিত হয়ে গেছে। এ ধারণা ভুল । মাসআলা হল, যিলহজ্বের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে ১২ তারিখ সুর্যাস্ত পর্যন্ত মােট তিন দিন কুরবানী করা যায়। এ তিন দিনের যেকোন সময় কেউ নেসার পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাকেই কুরবানী দিতে হবে। -নসবুররায়া ৪/২১২-২১৩; বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮; রদ্দুল মুখতার ২/৩১৮; আলমগীরী ৫/২৯৫
.
নিজের ওয়াজিব কুরবানী না দিয়ে মা-বাবার কুরবানী দেওয়া
---------------------------------------------------------------------------
.
ছেলে প্রতিষ্ঠিত হলে যখন মা-বাবা বার্ধক্যে পৌছে যায় এবং তাদের উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়, তখন ছেলে কেবল তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়। অথচ তার নিজের উপরও কুরবানী ওয়াজিব। সে নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায় না করে মা-বাবার কুরবানী দেয় এবং মনে করে, এর দ্বারা তার দায়িত্ব আদায় হয়ে গেছে। এটি ভুল। ছেলের উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়ে থাকলে নিজের কুরবানী অবশ্যই দিতে হবে। এরপর যদি সামর্থ্যে কুলায় তাহলে ইচ্ছ হলে মা-বাবার পক্ষ থেকেও ভিন্ন কুরবানী দিতে পারবে। অবশ্য কেউ নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায়ের ক্ষেত্রে মা-বাবাকে সওয়াব পৌছানাের নিয়ত করলে তার ওয়াজিব কুরবানী আদায় হয়ে যাবে এবং মা-বাবাও সওয়াব পেয়ে যাবেন।
.
যৌথ পরিবারে শুধু কর্তার কুরবানী
------------------------------------------------
.
যৌথ পরিবারে অনেক একাধিক উপার্জনকারী ব্যক্তি থাকে। যাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন মালিকানাধীন সম্পদ রয়েছে। কিন্তু যৌথ পরিবার বিধায় শুধু পরিবারের কর্তার কুরবানীই দেওয়া হয়। প্রত্যেক উপার্জনকারীর কুরবানী দেওয়া হয় না। এটা ভুল। যৌথ পরিবার হােক বা ভিন্ন পরিবার তােক প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই তার উপর কুরবানী ওয়াজিব ওয়াজিব। যৌথ পরিবারের কর্তার করবানী দিলে তা পরিবারস্থ সকলের জন্য যথেষ্ট হবে না।
.
কুরবানীর পশু ক্রয় ও শরিক নিয়ে বিভ্রান্তি
=============================
.
অধিক মূল্যের বা সবচেয়ে বড় পশু ক্রয়ের প্রতিযােগিতা
---------------------------------------------------------------------------
.
আজকাল বিত্তবান লােকদের মধ্যে কে কত বেশি মূল্যের পশু কিনতে পারে কিংবা কার কুরবানীর পশু কত বড় এ নিয়ে প্রতিযােগিতা হয়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে উট কেনার প্রতিযােগিতা এবং পত্রপত্রিকায় ফলাও করে নাম ছাপা হতেও দেখা যায়। কোন কোন সময় এধরনের নজরকাড়া পশু এলাকায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রদর্শন করা হয়। এসব হল চরম মূখর্তা। কুরবানী কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইবাদতের জন্য প্রথম শর্ত হল 'এখলাস’ তথা একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য করা। নিজের বড়ত্ব প্রকাশ, লােকের বাহবা পাওয়া, লােকদেখানাে মনােভাব ইত্যাদি থাকলে ওই ইবাদত কবুল হবে না।
অবশ্য একথা কারাে অজানা নয় যে, কুরবানীর পশু যত বড় হবে এবং যত ভাল হবে তত বেশি নেকী হবে, যদি তা হয় কেবল আল্লাহ তাআলাকে রাজিখুশি করার নিয়তে।
.
কুরবানী দেওয়ার নিয়তে পশু কিনে পরে শরিক নেওয়া ---------------------------------------------------------------------------
.
যদি শরীকে কুরবানী করতে হয়, তাহলে পশু ক্রয় করার আগেই শরিক নির্ধারণ করে নেওয়া উত্তম। যদি এটা সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত ক্রয়েরয় অন্য শরীক অন্তর্ভুক্তির নিয়ত করে নিবে। পরে কোন শরিক পাওয়া গেলে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে, ক্রয়ের সময় একা কুরবানী করার জন্য পশু ক্রয় করে, অতপর কোন কারণে অন্যকে শরিক করতে হয় এ অবস্থায় মসআলা কী হবে তা অনেকেরই জানা নেই। তাই মাসআলাটি বিস্তারিত লেখা হল।
ক. পশু ক্রয়কারী ব্যক্তি যদি এমন হয় যার উপর কুরবানী ওয়াজিব, তাে যদিও তার জন্য পরবর্তীতে কাউকে শরিক করার সুযােগ আছে, কিন্তু এমনটি না করাই উত্তম। করলে অন্যান্য শরিকদের অংশ পরিমাণ মূল্য সদকা করে দেওয়া উত্তম।
খ. যদি একা কুরবানী করার উদ্দেশ্যে পশু ক্রয়কারী ব্যক্তি এমন হয়, যার উপর কুরবানী ওয়াজিব ছিল না তাে তার জন্য অন্য কাউকে ওই পশুর মধ্যে শরিক করা জায়েয নেই। কেননা যার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয় সে যদি কুরবানীর পশু ক্রয় করে এবং ক্রয়ের সময় অন্য কাউকে শরিক করার নিয়ত না থাকে, তাহলে তার পুরাে পশুটিই কুরবানী করা জরুরি। যদি মাসআলা না জানার কারণে বা অন্য কোন করণে দ্বিতীয় কাউকে শরিক করে নেয়, তাহলে সে পরিমাণ মূল্য সদকা করে দেওয়া জরুরি। -কাযীখান ৩/৩৫০-৩৫১; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১০; রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৭; তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬২
.
শরিক নির্বাচনে অসর্তকতা
-------------------------------------
.
শরিকে কুরবানী দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেককেই যাচাই বাছাই ছাড়া শরিক নিতে দেখা যায়। অধিকাংশ উপার্জন হারাম এধরনের ব্যক্তিকেও শরিক নিয়ে নেওয়া হয়। অথচ এমন ব্যক্তিকে শরিক নিলে শরিকদের কারাে কুরবানীই সহীহ হবে না। সুতরাং এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
.
সাতের কম সংখ্যক শরিক
------------------------------------
.
অনেকে মনে করেন সাতজনের কমে শরিক নেওয়া যায় না। মনে করা হয়, হয় একা কুরবানী করতে হবে নতুবা শরিক নিতে হলে অবশ্যই সাতজন পূর্ণ করতে হবে। এ ধারণা ভুল। এমনিভাবে কেউ কেউ শরিক সংখ্যা বেজোড় হওয়া জরুরি মনে করে। এটি ও ভুল। সাত বা সাতের কমে যেকোন সংখ্যক শরিক নেওয়া যেতে পারে।
.
ত্রুটিযুক্ত কুরবানীর পশু
=================
.
পশুর শিং ভাঙ্গা থাকা বা একেবারেই না থাকা
--------------------------------------------------------------
.
অনেকে মনে করেন, পশুর শিং অল্পস্বল্প ভাঙ্গা থাকলেই ওই পশু দ্বারা কুরবানী হবে না। এ ধারণা ঠিক নয়। সহীহ মাসআলা হল, যে পশুর শিং একেবারেই গােড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েজ নেই। পক্ষান্তরে যে পশুর শিং আংশিক ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারেই উঠেনি সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ। -জামে তিরমিযী ১/২৭৬ ; সুনানে আবু দাউদ ৩৮৮; বাদায়েউস সানায়ে। ৪/২১৬ ; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪; আলমগীরী ৫/২৯৭
.
অন্তঃসত্ত্বা পশু কুরবানী
--------------------------------
.
অনেকে অন্তঃসত্ত্বা পশুর কুরবানী না জায়েয মনে করে থাকে। অথচ এধারণা সহীহ নয়। এধরনের পশুর কুরবানী জায়েজ। তবে বাচ্চা দেওয়ার সময় আসন্ন হলে সেটা কুরবানী করা মাকরূহ। -কাযী খান ৩/৩৫০; আলমগীরী ৫/৩০২
.
কুরবানীর পশু জবাই সম্পর্কীয় ভ্রান্তিসমূহ
=============================
.
হুজুরকে দিয়ে জবাই করানাে জরুরি মনে করা
---------------------------------------------------------------
.
অনেকেই কুরবানীর পশু মসজিদের ইমাম বা হুজুরকে দিয়ে জবাই করানাে জরুরি মনে করে। অথচ এটি ভুল ধারণা। কুরবানীদাতা জবাই করতে জানলে নিজেই জবাই করা উত্তম। -মুসনাদে আহমাদ হাদীস ২২৬৫৭; আলমগীরী ৫/৩০০; ইলাউস্ সুনান ১৭ /২৭১-২৭৪; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২
.
কুরবানীর আগে শরিকদের নাম পড়া
---------------------------------------------------
.
সাধারণত কুরবানীর আগে সকল শরিকের নাম পিতার নামসহ পড়াকে জরুরি মনে করা হয়। ফলে অধিকাংশ জায়গায় পশুকে শুইয়ে বেধে জবাইয়ের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত করার পরও জবাইকারীকে ওই নামের তালিকা পড়তে দেখা যায়। একাজটি নিতান্তই ভুল। শরিকদের নাম পড়া জরুরি নয়। এমনকি জবাইকারী শরিকদের কথা না জেনে জবাই করলেও সকল শরিকের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। কেননা কাদের কুরবানী করা হচ্ছে তাতাে নির্দিষ্টই আছে। এখন জবাইয়ের মুহূর্তে নামের তালিকা উচ্চারণ করার কোন প্রয়ােজন নেই। জবাইয়ের আগে এভাবে নাম উচ্চারণ করাটা সালাফ থেকে প্রমাণিত নয়। আর এমন অপ্রয়ােজনীয় একটি কাজের জন্য পশুকে জবাইয়ের পুর্বে কতইনা কষ্ট দেওয়া হয়।
.
জবাইয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তির সহযােগিতা
-------------------------------------------------
.
অনেক ক্ষেত্রে জবাইকারী জবাই করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে কসাই বা অন্য কেউ এসে ছুরি ধরে এবং বাকি জবাই পূর্ণ করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বিসমিল্লাহ বলতে শােনা যায় না। যদি প্রথম ব্যক্তির জবাই সম্পন্ন না হয় (অর্থাৎ দুই শাহরগ, শ্বাস নালী ও খাদ্যনালী-এ চারটির কমপক্ষে তিনটি কাটা না হয় ) তাহলে দ্বিতীয় জনকে অবশ্যই বিসমিল্লাহ বলতে হবে। অন্যথায় জবাই অশুদ্ধ হয়ে যাবে। ওই পশুর গােস্ত খাওয়া হালাল হবে না। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪
.
ওজর ছাড়া ১১ বা ১২ তারিখে কুরবানী করা
-------------------------------------------------------------
.
সাধারণত যাদের একাধিক কুরবানী থাকে তাদেরকে ১০ তারিখে একটি এবং ১১ বা ১২ তারিখে অন্যটি কুরবানী করতে দেখা যায়। বিনাওজরে এমন করা ঠিক নয়। বিনাওজরে প্রথমদিন কুরবানী না করে পরে কুরবানী দেওয়া অনুত্তম। -মুআত্তা মালেক ১৮৮; বাদায়েউস্ সানায়ে ৪/১৯৮; আলমগীরী ৫/২৯৫
.
পণ্ড ঠাণ্ডা হওয়ার আগে চামড়া ছিলা
--------------------------------------------------
.
অনেকেই পশু ঠাণ্ডা হওয়ার আগে পায়ের রগ কাটা এবং চামড়া ছিলা শুরু করে। এতে পশু কষ্ট পায়। এটি মাকরূহ। পশুকে প্রয়ােজনের অতিরিক্ত কষ্ট দেওয়াই গুনাহ। -জামে তিরমিযি ১/২৬০, সূনানে আবু দাউদ ২/৩৩; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩; আলমগীরী ৫/২৮৭
.
গােম্ভ বণ্টন ও দান
=============
.
গােস্ত ওজন না করা
---------------------------
অনেকে শরিকে কুরবানী দিলেও গােস্ত অনুমান করে বণ্টন করে থাকে। অথচ শুধু অনুমান করে গােস্ত বণ্টন করা নাজায়েয। -কাযী খান ৩/৩৫১; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭
.
গােম্ভ ওজন করাকে সংকীর্ণতা ভাবা
--------------------------------------------------
.
অনেকে ওজন করে বণ্টন করাকে খুব অপছন্দ করে। এটাকে সংকীর্ণতা, বাড়াবাড়ি ইত্যাদি বলে কটাক্ষ করে। অথচ এটি শরীয়তের হুকুম। না জেনে এমন মন্তব্য করা ঠিক নয়।
.
তিনভাগ করা জরুরি ভাবা
-------------------------------------
.
অনেকে কুরবানীর গােস্ত তিনভাগ করে একভাগ নিজে রেখে, একভাগ আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও একভাগ ফকীর মিসকীনকে দেওয়া জরুরি মনে করেন। অথচ এভাবে বণ্টন করা জরুরি নয়, তবে উত্তম। কেউ এতে ত্রুটি করলে কোন গুনাহ হবে না এবং কুরবানীরও কোন ক্ষতি হবে না। কেউ কেউ পুরাে পশুকেই ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখে, কিছুই দান করে না। এটাও ঠিক নয়, অনুত্তম। -সূরা হজ্ব ৩৬ ; বাদায়ে উস্ সানায়ে ৪/২২৪; আলমগীরী ৫/৩০০
.
কুরবানীর গােস্ত বিধর্মীদের দেওয়া
-----------------------------------------------
.
অনেকে মনে করে , কুরবানীর গােস্ত হিন্দু বা বিধর্মীদেরকে দেওয়া জায়েয নেই। এধারণা ভুল। বিধর্মীদেরকেও কুরবানীর গােস্ত দান করা জায়েয। ইলাউস্ সুনান ১৭/২৮৩; আলমগীরী ৫/৩০০
.
ভৃত্য ও কাজের লােকদেরকে কুরবানীর গােস্ত দেওয়া
-----------------------------------------------------------------------
.
অনেকে কর্মচারী কাজের লােকদেরকে কুরবানীর গােস্ত দেওয়া ও খাওয়ানােকে নাজায়েয মনে করে। অথচ তাদেরকে পারিশ্রমিক হিসাবে না দিয়ে হাদিয়া দিলে কোন অসুবিধা নেই এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মত এদেরকেও কুরবানীর গােস্ত দেওয়া উচিত। তবে তার নির্ধারিত পারিশ্রমিক থেকে ভিন্নভাবে দিতে হবে।
.
চর্বি বিক্রি
-------------
.
কুরবানীর পর, ঢাকাসহ পুরাে দেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুরবানীর পশুর চর্বি কেনাবেচা হয়। অথচ কুরবানীর গােস্ত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি নাজায়েয। কেউ বিক্রি করলে পুরাে টাকা মিসকীনদেরকে সদকা করে দেওয়া জরুরি। -ইলাউস সুনান ১৭/২৫৯; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫; কাযী খান ৩/৩৫৪; আলমগীরী ৫/৩০১
.
কুরবানী নিয়ে আরাে কিছু ভ্রান্তি
======================
.
কুরবানীর দিনগুলােতে অন্য পশু জবাই করা
-------------------------------------------------------------
.
কুরবানীর তিন দিন কুরবানীর পশু ছাড়া অন্য কোন পশু জবাই করা যাবে না। এমনকি হাঁস-মুরগী বা গরু-ছাগলও নয়। এটি ভুল ধারণা। তবে কুরবানীর নিয়তে হাস, মুরগী ইত্যাদি (যেগুলাে দ্বারা কুরবানী সহীহ নয়) জবাই করা ধনী-গরিব সকলের জন্যই নাজায়েয। গােস্তের প্রয়ােজনে জবাই করতে কোন সমস্যা নেই। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৪; বাযযাযিয়া ৬/২৯০; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৩; আলমগীরী ৫/৩০০
.
আকীকা না দিয়ে কুরবানী
------------------------------------
.
অনেকের ধারণা, আকীকা না দিলে কুরবানী দেওয়া যায় না। তাই অনেকে কুরবানীই করে না। আবার অনেকের উপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও কুরবানী না দিয়ে আকীকা দেয়। অথচ এটি একেবারেই অমূলক। একটির সঙ্গে অপরটি শর্তযুক্ত নয়। তাই কোন কারণে আকীকা দেওয়া না হলেও ওয়াজিব কুরবানী অবশ্যই দিতে হবে।
.
অনাদায়ী কুরবানী
-------------------------
.
বিগত বছরের কুরবানী অনাদায়ী থাকলে অনেকেই পরবর্তী বছর কুরবানী দিয়ে থাকে। অথচ এভাবে বিগত বছরের কুরবানীর কাযা আদায় হয় না। এক্ষেত্রে নিয়ম হল প্রতি বছরের কুরবানীর জন্য অন্তত কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া। ৪/৩১১; মাবসুতে সারাখসী ১২/১৪; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২৯ ; ফাতহুল কাদীর ৮/৪৩২; মুলতাকাল আবহুর ৪/১৭০
.
হাজী সাহেবের নামে কুরবানী
----------------------------------------
.
অনেক হাজ্বী সাহেব দেশে তার কুরবানীর ব্যবস্থা করে যান। এটাকে তারা জরুরি মনে করেন। এক্ষেত্রে মাসআলা হল, যে হাজ্বী কুরবানীর দিনগুলােতে মুসাফির থাকবে তার উপর সাধারণ কুরবানী জরুরি নয়। হাঁ এরপরও যদি কেউ নফল হিসাবে কুরবানী দিতে চায় তবে সেটা ভাল। পক্ষান্তরে কোন হাজ্বী যদি মক্কায় হজ্বের আগে ১৫ দিন থাকার নিয়তে অবস্থান করে থাকে, তাহলে সে কুরবানীর দিনে যেহেতু মুকীম তাই কুরবানী দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে তার উপর সাধারণ কুরবানী করাও ওয়াজিব হবে। এই সাধারণ কুরবানী সে দেশেও দিতে পারবে। উল্লেখ্য, সাধারণ কুরবানী বলতে উদ্দেশ্য যা সকল সামর্থবান মুসলমানই করে থাকেন, আর হজ্বের কুরবানীর মাসআলা তাে জানাই আছে যে, তামাত্তু ও কেরান হজ্বে কুরবানী (দমে শুকর) ওয়াজিব। আর ইফরাদ হজ্বে কুরবানী নফল। -কাযী খান ৩/৩৪৪; বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫; -আদুররুল মুখতার ৬/৩১৫
.
জবাইয়ের আগে চামড়া বিক্রি
----------------------------------------
.
অনেক সময় চামড়াক্রেতাদের পীড়াপীড়িতে পশু জবাইয়ের আগেই চামড়া বিক্রি করে ফেলে। এমনকি মূল্যও নিয়ে নেয়। এমনটি করা নাজায়েয। চামড়া ছিলার আগে বিক্রি করা জায়েয নয়। তাই প্রয়ােজনে জবাইয়ের আগে বিক্রির ওয়াদা করা যেতে পারে, বিক্রি করা যাবে না। -আলমগীরী ৩/১২৮; আদুররুল মুখতার ৫/৬৩
[ মাসিক আলকাউসার | জানুয়ারি ২০০৭ ]

Post a Comment